চার বছরের কান্না, সমাজের নীরবতা
রাত গভীর হলে ঘুমিয়ে পড়ে শহর।
কিন্তু সেই রাতেও এক ঘরে শোনা যায় ছোট্ট এক কণ্ঠস্বর.“বাবা মারবে না তো?”
চার বছরের রাইসার মুখে এই বাক্য শুনে বরফ হয়ে যায় বাতাস।বাবা,যে শব্দটি আশ্রয়ের প্রতীক, সেই বাবার নাম এখন ভয়ের প্রতীক!
মায়ের মৃত্যু, আরেক নারীর আগমন, তারপর রাইসার জীবন অন্ধকারে! ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে রাইসার মা সুমাইয়া মারা যান। মা হারানো শিশু তখন খালার কোলে বড় হচ্ছিলো, তাকে “খালা-মা” বলেই ডাকত।
কিন্তু ওই ছোট্ট মুখের সেই মিষ্টি শব্দটাই হয়ে যায় বাবার কাছে বিষ! রাকিব হোসেন ধানসিঁড়ি পরিবহনের এক কন্ডাক্টর, নিজ কন্যার মুখে “খালা-মা” শুনে ক্ষেপে যায় দানবের মতো!
তারপর যা ঘটে..
হাত ওঠে, লাথি চলে, মাথা ফেটে যায়, চোখে জমে রক্ত, আর কান্নায় ভরে যায় এক শিশু শরীর।
চার মাসের নতুন বিয়ে, আর এক শিশুর শেষ আশ্রয় ভাঙে, রাকিবের দ্বিতীয় স্ত্রী কলি আক্তার।চার মাস হলো বিয়ে, কিন্তু তার গলায় ভালোবাসা নয়, বরং বিষের শব্দ। এই নারী,যাকে প্রতিবেশীরা বলেন “ঘৃণার মূর্তি, বাবার অনুপস্থিতিতে ছোট্ট রাইসার উপর নেমে আসে প্রতিদিনের নরক।
প্রতিবেশী লিজার মা জানালেন,
কলি মেয়েটিকে ঘরে রাখতে চাইত না। রাকিবের সঙ্গে এ নিয়ে ঝগড়া হতো। শেষে মেয়েটিই পেটের ঘা পেল।”এমনকি খালার কোলে থাকা শিশুকে টেনে নিয়ে গিয়ে মারধর করেছে তারা,যেন রাইসা তার নিজের ঘরেই অনাহূত অতিথি।
আদালতে মামলা, কিন্তু থানায় ‘মীমাংসার মহড়া! ৭ অক্টোবর আদালতে নানার নালিশ। বাদী আব্দুস সাত্তার হাওলাদার, সঙ্গে আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফয়সাল খান। আদালত পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন,“মামলা রেকর্ড করো।”
কিন্তু তারপর?
থানায় চলে রাতভর চায়ের আসর,
পুলিশের কথায় “আলোচনা”,সমাধান মীমাংসা”।একজন চার বছরের শিশু হাসপাতালে, আর থানায় শান্তি সম্মেলন!
এই কেমন সমাজ, এই কেমন প্রশাসন?
ওসির অজুহাত-“বাথরুমে পড়ে গেছে!
বাচ্চাটা বাথরুমে পড়ে গেছে।”অর্থাৎ, চোখ ফুলে যাওয়া, মাথা ফেটে যাওয়া,পুরো শরীর নীল দাগে ভর্তি, সবই নাকি বাথরুমে পড়ে যাওয়ার ফল”!
এই দেশে হয়তো একদিন শুনবো,
শিশুটি আগুনে পড়েছে, তাই পুড়ে গেছে!”
এমন নির্লজ্জ অজুহাত শুনে লজ্জা পায় না প্রশাসন, কিন্তু কাঁপে প্রতিটি বিবেকবান মানুষ।
হাসপাতালের বিছানায় রাইসা-শরীর বলে দিয়েছে, কী ভয়াবহ ছিল সেই রাত!
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের বিছানায় রাইসা শুয়ে আছে নিঃশব্দে। চোখ ফুলে গেছে, মুখে ব্যথা, মাথায় সেলাই, ডাক্তাররা বলছেন,শিশুর শরীরে পুরনো ও নতুন আঘাতের দাগ রয়েছে।”
নানি কহিনুর বেগম কান্না চেপে রাখতে পারেন না, “আমার নাতনিকে এমনভাবে মেরেছে যে ঘুমাতে পারে না। চোখে ব্যথা, রাতে জেগে কাঁদে।
একজন নানির কান্না আজ পুরো ঝালকাঠির কান্না।
চাপ, ভয় ও প্রভাবশালীদের ছায়া..রাইসার খালা শাহনাজ বলেন,আমরা ভয় পাই, স্থানীয় প্রভাবশালীরা চাপে রাখে। থানায় গেলেও কথা শোনে না।
প্রশ্ন একটাই…
চার বছরের শিশুর ওপর এমন বর্বরতা হলে
কোন আইন, কোন পুলিশ, কোন মানবতা মাথা তুলে দাঁড়াবে? রাইসার জন্য বিচার চাই,না হলে রাষ্ট্রের বিবেক মৃত!
এই রিপোর্ট শুধু এক শিশুর নয়, এটা এক জাতির মুখোশ উন্মোচনের গল্প।একজন বাবা যখন দানবে পরিণত হয়,একজন সৎ মা যখন শয়তানের ছদ্মবেশ পরে,তখন নীরব সমাজও হয়ে যায় তাদের সহযোগী।
আজ সবার দাবি..
অভিযুক্ত রাকিব হোসেন ও কলি আক্তারকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হোক। পুলিশের মীমাংসা নাটকের তদন্ত হোক।
রাইসাকে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হোক।
জেলা প্রশাসন ও মানবাধিকার কমিশনের সরাসরি নজরদারি নিশ্চিত করা হোক।
পরিশেষে বারংবার বলে যাই, রাইসা শুধু একটি শিশু নয়, সে আমাদের বিবেকের পরীক্ষা রাইসা এখন হাসপাতালে শুয়ে আছে, কিন্তু তার চোখের ভয়, তার মুখের নীরবতা, তার শরীরের দাগ,সবই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় আমাদের দিকে।
তোমরা মানুষ? নাকি মীমাংসা নামের বেপরোয়া পশু?”
আজ যদি রাইসার বিচার না হয়,
তাহলে আগামীকাল তোমার ঘরেও জন্ম নেবে আরেক রাইসা, আর তখন হয়তো সমাজের মীমাংসা নয়, জ্বলবে বিবেকের চিতা।











