শিক্ষকের বদলে কোচিং ব্যবসায়ী, শ্রেণিকক্ষের বদলে বাজার,মডেল’ স্কুল এখন ‘মডেল কোচিং সেন্টার’। অভিভাবকদের প্রশ্ন- শিক্ষা পবিত্র পেশা, না লাভজনক পণ্য?
নিজস্ব প্রতিবেদক।। বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ,শহরের একসময়ের নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখন এখানে চলছে এক নতুন পাঠ্যক্রম,কোচিং ছাড়া পাস অসম্ভব!
খণ্ডকালীন শিক্ষক এম মাহারুজ ইসলাম তৃষান অভিভাবকদের ভাষায়, স্যার নন, কোচিং উদ্যোক্তা। ক্লাসে পড়ান কম, প্রাইভেটের তালিকা বানান বেশি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ,স্যারের ক্লাসে না পড়লে পরীক্ষায় শূন্য, আর কোচিংয়ে নাম লিখালে সঙ্গে সঙ্গে হাসি!
ক্লাসরুমে নাটক, কোচিংয়ে ব্যবসা..
ছাত্ররা বলে, স্কুলে গিয়ে এখন আর কেউ শিক্ষা নিতে যায় না, যায় ‘অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে’। ক্লাসে তৃষান স্যার এমনভাবে পড়ান যেন পাঠ্যসূচি নয়, কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন।
এক শিক্ষার্থী মজা করে বলেছে, স্যার আমাদের ক্লাসে ম্যাথ পড়ান না, বলেন,এইটা কোচিংয়ে বুঝিয়ে দিবো।
অভিভাবকদের চোখে, এ যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে এক পূর্ণাঙ্গ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এডু কেয়ার কোচিং সেন্টার নাকি তার ‘অফিশিয়াল শাখা’, আর বাড়ির কোচিং ‘হেড অফিস’। বাচ্চারা সকাল থেকে স্কুলে, বিকেল থেকে কোচিংয়ে,রাতে শুধু হতাশার অঙ্ক কষে।
শিক্ষক নাকি উদ্যোক্তা?
তৃষান নিজে স্বীকার করেছেন, তিনি কোচিং চালান,এডু কেয়ার নামেই হোক বা বাসায়। কারণ তার ভাষায়, আমি খণ্ডকালীন শিক্ষক, সরকারি আইন আমার জন্য প্রযোজ্য নয়।অর্থাৎ, আইন আছে, কিন্তু তার গায়ে লাগে না। যেন শিক্ষা আইন কোনো “অলিম্পিক গেমসের নিয়ম”,শুধু ফুলটাইম শিক্ষকদের জন্য!
অভিভাবকরা বলেন,শিক্ষক অবিবাহিত, তাই বলে শিক্ষা বাণিজ্যে ‘বিবাহ’ কেন করবেন না? অর্থাৎ,ব্যক্তিগত জীবন তাঁর, কিন্তু পেশাগত নৈতিকতা সবার বিষয়।
নীতিমালা কাগজে, কোচিং বাস্তবে…
সরকার ২০১২ সালে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা করেছিল। ২০১৯ সালে গেজেট প্রকাশ, ২০২২ সালে নতুন খসড়া। কিন্তু শিক্ষকরা বলেন, “আমরা তো খণ্ডকালীন! এই খণ্ডকালীন অজুহাত এখন পুরোপুরি ফুলটাইম ব্যবসায় পরিণত। ক্লাসরুমে নোট দিয়ে বলেন,“বাকি অংশ কোচিংয়ে বুঝবো।শিক্ষার্থীরা বোর্ডের দিকে নয়, স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝে,আজকে কোন অধ্যায় কোচিংয়ে যাবে।
অধ্যক্ষের ‘আশ্বাস’ বনাম বাস্তবতা
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু মামুন বলেন,তৃষান কোচিং করানোর অনুমতি নেয়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। এই ‘খতিয়ে দেখা হবে’,বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রশাসনিক বাক্য। বছর পার হয়, রিপোর্ট আসে না। কিন্তু কোচিং ফি বাড়ে, অভিভাবকদের পকেট ফাঁকা হয়। অভিভাবকরা বলেন,আমরা বাচ্চাদের শিক্ষা দিতে স্কুলে পাঠাই, আর স্কুল আমাদের পাঠায় কোচিংয়ে!”
ফ্যাসিবাদের ছায়ায় ‘মডেল’ স্কুল
অভিভাবকদের মতে, সাবেক প্রশাসন থেকেই এই কোচিং সিন্ডিকেট বেড়ে উঠেছে। শিক্ষার নামে তৈরি হয়েছে এক ধরনের “ফ্যাসিস্ট কালচার”,যেখানে শিক্ষকই শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জিম্মি রাখেন।কোচিংয়ে না এলে ফেল”এমন হুমকি এখন পরীক্ষার রুটিনের অংশ।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সংকটে
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অতিরিক্ত কোচিং শিশুদের মানসিক চাপ বাড়ায়, সৃজনশীলতা নষ্ট করে, আত্মবিশ্বাস গিলে ফেলে।বাচ্চারা এখন বইয়ের চেয়ে স্যারের মুখে ভয় পায়,বলেন এক অভিভাবক।সকালে স্কুল, বিকেলে কোচিং, রাতে হোমওয়ার্ক,এ যেন শিক্ষা নয়, শ্রমিকের ডিউটি!খেলাধুলা নেই, বিশ্রাম নেই, আছে শুধু ফলাফলের প্রতিযোগিতা আর স্যারের রাগ।
শিক্ষকতা নয়, ব্যবসা…
তৃষানের ঘটনা কোনো একক ব্যতিক্রম নয়,এটা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার নগ্ন প্রতিচ্ছবি। শিক্ষকরা এখন পেশাজীবী নয়, উদ্যোক্তা। স্কুল ক্লাস যেন বিজ্ঞাপন বিরতি, আর কোচিংই মূল অনুষ্ঠান।
শিক্ষা যদি ব্যবসা হয়, তবে শিশুরা পণ্য, আর শিক্ষক তার মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ। আজ কোচিং স্যারদের লাগাম না টানলে আগামী প্রজন্ম পড়বে শুধু একটিই অধ্যায়,শিক্ষাই শক্তি নয়, শিক্ষাই ব্যবসা!”










