প্রশাসনকে বৃদ্বা আঙ্গুল দেখিয়ে কাউনিয়া মানিক মিয়া স্কুল সংলগ্ন বরিশালের হারিজন পল্লীতে চলছে জমজমাট মাদক ব্যবসা ও বাংলা মদের আসর!
নিজস্ব প্রতিবেদক।।বরিশাল মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র কাউনিয়া এলাকায় অবস্থিত হরিজন কলোনি।
এই কলোনিটি পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বসবাসের জন্য পরিচিত হলেও গত কয়েক বছরে এলাকাটি আরেকটি চাঞ্চল্যকর পরিচয়ে পরিণত হয়েছে চোলাই মদ ওরফে বাংলা মদের কেন্দ্রস্থল হিসেবে। আর এই অবৈধ ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ঝাড়ুদার পদে কর্মরত মিলন নামের এক ব্যক্তি, যিনি এখন এলাকায় ‘কোটিপতি মিলন’ নামে বেশি পরিচিত।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে মিলনের ডেরায় শুরু হয় মদ্যপানের আসর। স্থানীয় ও বাহিরের নানা বয়সী মানুষ একে একে মিলনের আস্তানায় ভীড় জমায়। কাঁচা চোলাই মদ বিক্রি হয় খোলা বাজারের মতই। কেউ কেউ আধা বোতল, কেউবা পুরো বোতল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন গলির ভেতর বা পাশের মাঠে। কেউ কেউ বসে পড়ছেন মিলনের উঠোনেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদন অনুযায়ী, হরিজন কলোনির সদস্যরা সীমিত পরিসরে নিজেরা দেশীয় চোলাই মদ সেবনের অনুমতি পেলেও, সেটি বেচাঁকেনার ক্ষেত্রে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই দিনের পর দিন প্রকাশ্যে চলছে মদ বিক্রি।
স্থানীয়দের মতে, এই ব্যবসা এতটাই স্থায়ী এবং সুনির্দিষ্ট যে প্রশাসনের অজানা থাকার কোনো সুযোগ নেই। অভিযোগ রয়েছে, মিলন প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিয়ে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী নেতা ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার আশীর্বাদ নিয়ে নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাসিন্দা বলেন, “কতবার বলেছি ওরা যাতে না বেঁচে , কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। পুলিশের কাছে গেলেও বলে, ‘ও তো হরিজন, ওদের অনুমতি আছে।’ অথচ অনুমতি তো বিক্রির না, খাওয়ার। যেখানে সিটি কর্পোরেশনের একজন ঝাড়ুদারের মাসিক বেতন ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকার মধ্যে, সেখানে মিলনের জীবনযাত্রা এবং আর্থিক অবস্থা দেখে বিস্ময়ে হতবাক এলাকাবাসী। মিলনের বাড়িতে রয়েছে ফ্রিজ, এলইডি টিভি, মোটরসাইকেল এমনকি তথ্য মতে, সে এখন একটি মাইক্রোবাস কেনার পরিকল্পনাও করছে।
স্থানীয়ভাবে গুঞ্জন রয়েছে, তার মাসিক মাদক বিক্রির টাকার অঙ্ক কয়েক লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এই অবৈধ মদ বিক্রির প্রভাবে হরিজন পল্লী ও আশেপাশের এলাকায় অপরাধের হার চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। নিয়মিত ঘটছে চুরি, ছিনতাই, এমনকি মাদকসেবীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও। কয়েক মাস আগে দুই মাদকসেবীর মধ্যে চোলাই মদের ভাগাভাগি নিয়ে হাতাহাতি থেকে ছুরিকাঘাতের ঘটনাও ঘটে।এই মাদক ব্যবসা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও মানবিক বিপর্যয়ের রূপ নিচ্ছে। হরিজন পল্লীর অনেক তরুণ এখন চোলাই মদের নেশায় ডুবে যাচ্ছে। কেউ কেউ স্কুলছুট হয়ে পড়ছে, আবার কেউ ঘরবাড়ি বিক্রি করে নিঃস্ব হচ্ছে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে না পেরে চুরি বা কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে অনেকেই। বরিশালের সচেতন নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন এবং স্থানীয় শিক্ষক-অভিভাবকরা বিষয়টি নিয়ে দিন দিন আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। তারা চান অবিলম্বে মিলনের ডেরা ভেঙে সেখানে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হোক। হরিজন কলোনির বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, মিলন আমাদের কলোনির সুনাম নষ্ট করছে। ওর কারণে পুরো হরিজন সম্প্রদায়কে এখন মাদক ব্যবসায়ী মনে করা হয়, এটা খুবই লজ্জার। সিটি কর্পোরেশনের মতো একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন কর্মচারীর পক্ষ থেকে প্রকাশ্য ও দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ মদ ব্যবসা চালানো কেবল প্রশাসনের উদাসীনতার উদাহরণই নয়, বরং এটি একটি গুরুতর সামাজিক ব্যর্থতা। যেখানে সাধারণ নাগরিকরা তুচ্ছ অপরাধেও অভিযুক্ত হচ্ছে, সেখানে মিলনের মত ব্যক্তি দিনের পর দিন অপরাধ করেও রয়ে যাচ্ছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান হরিজন পল্লীর সদস্যদের কিছু সীমিত সেবনের অনুমতি থাকলেও তা কোনোভাবেই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নয়। বিষয়টি যদি সত্যি হয়, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। তবে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা ছাড়া একা আমাদের কিছু করা কঠিন। সিটি কর্পোরেশনের নীরবতা
সিটি কর্পোরেশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন,
আমাদের কাছে এই ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেব।”
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এত বড় পরিসরে একজন কর্মচারীর এই ধরনের কর্মকাণ্ড প্রশাসনের নজর এড়িয়ে গেল কীভাবে? মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বাস্তবায়ন তখনই কার্যকর হবে, যখন সমাজের প্রতিটি স্তরে সমানভাবে এই নীতি প্রয়োগ করা হবে। একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী হোক বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা—আইনের চোখে সবাই সমান। কাউনিয়া হরিজন কলোনিতে মিলনের নেতৃত্বে যে মাদক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, তা শুধু একটি পল্লী নয়, বরিশাল শহরের সার্বিক নিরাপত্তা ও সামাজিক ভারসাম্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন সময় হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনকে জবাবদিহির আওতায় এনে, একটি নজির স্থাপন করার যাতে আর কোনো ‘মিলন’ দেশের মাটি ও ভবিষ্যৎকে নষ্ট করতে না পারে।